Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

বিমান কী করে বাতাসে ভাসে?

 

 

আমরা সবাই বাতাসের বিপরীতে পালতোলা নৌকাকে নদীতে ভেসে চলতে দেখেছি, মৃদুমন্দ বায়ুতে ঘুড়িকে স্থির হয়ে থাকতে দেখেছি আকাশে, দেখেছি ডানা না ঝাঁপটেই আকাশে গোলকার কিংবা কৌণিক পথে বাজ, ঈগল প্রভৃতি শিকারী পাখিদের উড়তে। আসলে শুধু দেখেছি-ই না, বরং এখনো প্রতিনিয়ত দেখছিও বটে। এই ঘটনাগুলো আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত এত বেশি করে ঘটে চলেছে যে এদেরকে অবধারিত কিংবা খুবই সাধারণ ঘটনা ভেবেই বসে আছি সবাই। হ্যাঁ, এই ঘটনাগুলো হয়ত সাধারণ কিন্তু এদের পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু অসাধারণ কারণ। সেই কারণগুলো খুঁজে বের করার কথা খুবই কম মানুষের মনেই এসেছে। খুব কম মানুষই নিজেকে কিংবা অন্যকে প্রশ্ন করেছে, কেন এমন হয়? কিন্তু যখন পৃথিবীর প্রথম মানুষ উড়ার চেষ্টা করলেন; দুই হাতে ডানা লাগিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিলেন; যখন বাতাসের চেয়ে ভারী মেশিনে চড়ে মানুষ বাতাসেই ভেসে উঠল; উড়ল; মেশিনটাকে ডানে-বামে, উপর-নিচে মুখ করিয়ে বাতাসে ভেসেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে গেল দ্রুত তখন দ্রুতই চারপাশের সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, কেন এমন হয়? কীভাবে বাতাসে ভাসে ওই মেশিনটা?

সেদিনের সেই মেশিনটার আজকের নাম বিমান। বিমান কী করে বাতাসে ভাসে?- এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের সন্ধানে পদার্থবিদ এবং অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা এখনো তর্কে মাতেন। বিমানে অহরহ চড়েন এমন মানুষের অভাব নেই। কিন্তু তাদের কতজন জানেন বিমান কী করে উড়ে কিংবা কতজনই বা জানতে আগ্রহী? যারা জানতে আগ্রহী তাদের জন্যেই এই প্রবন্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি’তে অবস্থিত Smithsonian National Air and Space Museum’ এর Aerodynamics’বিভাগের কিউরেটর ডঃ জন ডি এন্ডারসন বলেন, 'রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিস্ময়কর আবিষ্কারের শত বছর পেরিয়ে গেলেও অসংখ্য মানুষ আজও এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। কেউ কেউ হয়ত যেটা জানেন সেটা ভুল। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা এর মধ্যেও ধর্মকে টেনে আনেন!” তবে এন্ডারসন মনে করেন না স্বর্গ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত ঝুলে থাকা কোনো দড়ি এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে।

বিমানের বাতাসে ভাসতে পারার ব্যাপারটিকে অনেকেই অনেকভাবে ব্যাখ্যা করলেও সবচেয়ে প্রচারিত ব্যাখ্যা মতে বাতাস বিমানের উইং (ডানা) এর বক্রতাবিহীন তলদেশের চেয়ে বক্রতাবিশিষ্ট উপরিতলের উপর দিয়েই বেশি দ্রুত প্রবাহিত হয় বলেই বিমান বাতাসে ভাসে।

চিত্রঃ বিমানের উইং বা ডানা

ফ্লুইড (জলীয় বা গ্যাসীয় পদার্থ, যেমন বাতাস) যত দ্রুত প্রবাহিত হয় তত কম চাপ সৃষ্টি করে। বিপরীত ক্রমে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে প্রবাহিত বাতাস উইং’এর নীচের তলে দ্রুত গতিতে প্রবাহিত বাতাসের চেয়ে বেশি চাপ সৃষ্টি করে। আর এই বেশি চাপই উপরের দিকে ক্রিয়াশীল একটি বল (Lift) সৃষ্টি করে, যেটি বিমানটিকে উপরের দিকে ঠেলে এবং মাধ্যাকর্ষণজনিত নিম্নমুখী আকর্ষণ বলের সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে। এই তথ্যটির অবতারণা করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর সুইশ গণিতবিদ ড্যানিয়েল বার্নোলি আর তার নামানুসারেই তথ্যটির নামকরণ করা হয়েছে “Bernoulli’s Principle”।

তথ্যটি পুরোপুরি সঠিক হলেও উইং’এর উপরের দিকের বাতাস কেন নীচের তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দ্রুত প্রবাহিত হয় তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। আর এই অপূর্ণতাই আরও দ্বিধার সৃষ্টি করেছে।

ম্যাকিন্টোশ কম্পিউটারের জনকদের একজন, জ্যাফ রাস্কিন মিডল স্কুলে থাকার সময় তার ক্লাসের বিজ্ঞানের শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “Lift যদি উইং এর আকার অথবা এটি কী অবস্থায় আছে কিংবা কোন দিকে মুখ করে আছে তার উপর নির্ভর করে তাহলে উইং এর সামনের অংশ নীচু করলে বিমানটি নীচের দিকে ঠেলা অনুভব না করে, মাটিতে আছড়ে না পড়ে উড়তে থাকে কী করে? আর আমরা যে কাগজের বিমান বানাই সেটার দুটো উইং’এর আকারই তো সমান, মসৃণ এবং মোটেই উপর-নীচ মুখ করে দেয়ার উপর নেই; তাহলে সেটি উড়ে কী করে?” শিক্ষক প্রথমেই তাকে বুঝাতে চেষ্টা করলেন যে উইং’এর সামনের অংশ নীচু করলে বিমান কখনই উড়তে পারে না। কিন্তু রাস্কিন শিক্ষকের ব্যাখ্যা অগ্রাহ্য করে বললেন তিনি ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেছেন। শিক্ষক দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলেন কাগজের বিমান পুরোপুরি ভিন্ন বৈজ্ঞানিক সূত্রের উপর নির্ভর করে উড়ে। রাস্কিন বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক পুরোপুরি ভুল, অযৌক্তিক এবং অসত্য ব্যখ্যা দিচ্ছেন এবং এর প্রমাণও তার কাছে ছিল। পরদিন রাস্কিন ক্লাসে একটি কাঠের তৈরি মডেল বিমান (Balsa-wood model airplane) নিয়ে আসলেন এবং দেখালেন যে যখন বিমানটির উইং নীচের দিকে ঘুরানো থাকে কেবল তখনই সেটি উড়ে।

চিত্রঃ Balsa-wood made airplane

হেরে গিয়ে শিক্ষক অপমানিত বোধ করলেন এবং রাস্কিনকে প্রিন্সিপালের রুমে প্রেরণ করলেন। প্রিন্সিপাল তাকে আচার-আচরণে আরও সংযত এবং ভদ্র হবার নির্দেশ দিলেন।

বহুদিন পর ১৯৯৪ সালে রাস্কিন উইং সংক্রান্ত এই সমস্যা এবং উড়ন্ত বিমানের ভেতর একটি বলের (Ball) কোণ সৃষ্টি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার কারণ ব্যাখ্যা করে ‘Quantum Magazine’এ একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেটিতে তিনি বলেন বার্নোলি’র তথ্যটি নির্ভুল কিন্তু শিশুসুলভ। জনাব রাস্কিন এবং অন্যান্যরা বুঝতে পারেন স্যার আইজ্যাক নিউটনের গতিসূত্রগুলো ব্যাপারটিকে বার্নোলি’র তথ্যের চেয়ে অধিকতর সহজে ব্যাখ্যা করতে পারে। রাস্কিন প্রবন্ধে আরও বলেন, “উইং এমন একটি বস্তু যা বাতাসকে নীচের দিকে ঠেলতে পারে।” আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র (প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে) থেকে বলা যায় উইং বাতাসকে নীচের দিকে ঠেলতে যে নিম্নগামী বল প্রয়োগ করে সেটি একটি সমান উপরিগামী বল সৃষ্টি করে, যেটি Lift সৃষ্টি করে এবং বিমানটিকে ভাসিয়ে রাখে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কতটুকু বাতাস স্থানাতরিত হবে তা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে বাতাসে উড়ার সময় উইং- এ উৎপন্ন কোণের উপর, মোটেই উইং এর আকারের উপর নয়। উইং- এ উৎপন্ন কোণটি ‘Angle of attack’ নামে পরিচিত। Angle of attack বাড়িয়েই পর্যাপ্ত Lift সৃষ্টি করে বিমান বাতাসে ভাসে।

চিত্রঃ Angle of attack

চিত্রঃ Coanda Effect

উইং কী করে বাতাসকে নীচের দিকে ঠেলে? এই প্রশ্নের উত্তরে যারা বলবে বাতাসের অণুগুলো উইং এর গায়ে ধাক্কা খেয়ে নীচের দিকে চলে যায় তারা পুরোপুরি ভুল করবে। আসল ব্যাপার হলো বায়ু চাপ এবং বায়ুকণার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল বাতাসকে উইং’এর দিকে ঠেলে (একে Coanda Effect বলে) আর তারপর উইং এর Angle of attack এর কারণে বিপুল পরিমাণ বাতাস নীচের দিকে সরে আসতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ উড়ন্ত অবস্থায় কোনো কারণে উইং যদি ভেঙে যায় তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হবে এবং বিমানটি ভূপাতিত হবে।

‘Understanding Flight’ বইয়ের সহ গ্রন্থকার, University of Washington’এর Astronautics and Aeronautics বিভাগের ডঃ ডি স্কট এবারহার্ড বলেন, “একটি 747 উড়ার সময় এর উইং প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ৯ লক্ষ পাউন্ড বাতাস স্থানান্তর করে।”

চিত্রঃ Boeing 747

তিনিও স্বীকার করেন বার্নোলির তথ্য সঠিক। তবে তার মতে ননটেকনিক্যাল মানুষদের কাছে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে নিউটনের সূত্রই বেশি উপযোগী।

সবশেষে একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন- “বাতাসের বদলে যদি এমন একটি ফ্লুইড থাকে যেটির কণাগুলোর মধ্যে একদমই আন্তঃআণবিক আকর্ষণ নেই তাহলে কি কোনো বিমান উড়তে পারবে?” আমরা জানি আল্ট্রাকোল্ড হিলিয়াম এমনই একটি ফ্লুইড, যা কোনোরকম ঘর্ষণ ছাড়াই প্রবাহিত হতে পারে। তাহলে বাতাসের বদলে আল্ট্রাকোল্ড হিলিয়াম থাকলে কি বিমানের উইং তা নীচের দিকে ঠেলতে পারবে? বিমান উড়তে পারবে?

‘Understanding Flight’ বইয়ের সহগ্রন্থকার, পদার্থবিদ ডঃ এন্ডারসন Super fluidity বিমানের এই নীতি বুঝেন এমন অসংখ্য মানুষকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন। কিন্তু কারো কাছেই সদুত্তর না পেয়ে হতাশ কণ্ঠে বলেছিলেন, “Alas! They don’t understand flight!”

(নিউইয়র্ক টাইমস’এ প্রকাশিত ক্যানেথ চ্যাং’এর “STAYING ALOFT: WHAT KEEPS THEM UP THERE?” শীর্ষক প্রবন্ধ অবলম্বনে রচিত।)